হালদা নদীর এক মা মাছ থেকেই বছরে প্রায় ৪ কোটি টাকার আয়!
চট্টগ্রাম, ১৪ জুন ২০২৫: হালদা নদী দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক কার্প প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। এই নদীর মা মাছের প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ডিম থেকে যে রেণু বা পোনা তৈরি হয়, তার আর্থিক মূল্য দেশের মৎস্য অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা গেছে, হালদার এক মা মাছ থেকে বছরে গড়ে প্রায় ৪ কোটি টাকার সমমূল্যের মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব।
প্রাকৃতিক প্রজননের অনন্য ক্ষেত্র
হালদা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এ নদী দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র নদী, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে মা মাছ ডিম ছাড়ে। প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত হালদা নদীতে রুই, কাতলা, মৃগেলসহ কার্প জাতীয় মাছগুলো ডিম ছাড়ে। নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলপ্রবাহ এবং তলদেশের মাটি ডিম ফোটানোর জন্য উপযুক্ত বলে এখানে ডিমের মানও উন্নত।
এক মা মাছের আর্থিক অবদান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হালদা নদীর একেকটি মা মাছের ডিম থেকে উৎপাদিত রেণু বা পোনা পাঁচ বছরে গড়ে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমান মূল্য সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ, বছরে এক মা মাছের উৎপাদিত পোনার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। এই পরিমাণ আয় মূলত স্থানীয় জেলে পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য এনে দেয়, পাশাপাশি দেশের মৎস্য উৎপাদনেও বড় ভূমিকা রাখে।
স্থানীয়দের জীবিকা ও অর্থনীতি
হালদা নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে স্থানীয় জেলেপাড়া, যারা ডিম সংগ্রহ, পোনা উৎপাদন এবং বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রতি মৌসুমে কয়েক হাজার মানুষ হালদার ডিম সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এসব পোনা দেশের বিভিন্ন জেলার মাছচাষিদের কাছে বিক্রি করা হয়। এতে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্প জাতীয় মাছ চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে।
হুমকি ও চ্যালেঞ্জ
যদিও হালদা নদীর মা মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন দেশের জন্য আশীর্বাদ, তবু নদীটির অস্তিত্ব নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নদীর বুকে অবৈধ বালু উত্তোলন, শিল্প কারখানার বর্জ্য, পলিথিন দূষণ, নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা, নাব্যতা সংকট এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে মা মাছের প্রজনন হুমকির মধ্যে পড়েছে। ২০২০ সালে যেখানে প্রায় ২৫ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেখানে ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ হাজার ৬৬০ কেজিতে।যদিও ২০২৫ সালে ১৫ হাজার কেজি মত ডিম সংগ্রহ করা গিয়েছে ; তবে অতীত রেকর্ড বলে হালদায় এক সময় মা মাছ ১.৫ লাখ কেজি ডিমও ছেড়েছে।
সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার নদীটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ECA) ঘোষণা করেছে। এছাড়া এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মা মাছের নিরাপদ প্রজননের জন্য নৌযান চলাচল, বালু উত্তোলন এবং মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নদী তদারকিতে কাজ করছে। এছাড়া হালদা গবেষণা কেন্দ্র ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হালদার প্রজনন ও পরিবেশ রক্ষায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞদের মতে, হালদা নদীর মা মাছের ডিম ও পোনা উৎপাদন সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা গেলে দেশের মাছের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এটি হাজার হাজার মানুষের জীবিকা, দেশের অর্থনীতি ও মৎস্যসম্পদের টেকসই উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।