হালদা নদী বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক রুইজাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই নদী প্রকৃতি ও মৎস্যজীবীদের জন্য আশীর্বাদ। এখানে প্রাকৃতিকভাবে প্রতি বছর রুই, কাতলা, মৃগেলসহ নানা প্রজাতির রুইজাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণেই হালদা নদীকে ২০২০ সালে মৎস হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে এ নদীর অস্তিত্ব ও স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা আজ হুমকির মুখে। একদিকে অবৈধ বালু উত্তোলন, অন্যদিকে নদীতে কারেন্ট জাল ফেলে মাছ শিকার ও নদীর তীরে শিল্পবর্জ্য ফেলার মতো কর্মকাণ্ড নদীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশকে ধ্বংস করছে।
নদী রক্ষায় হালদায় নৌ থানা স্থাপনের দাবি নতুন নয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মৎস্যজীবী ও পরিবেশকর্মীরা বহু বছর ধরেই হালদা নদীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নৌ থানার দাবি জানিয়ে আসছেন। নদীর নিরাপত্তা ও অপরাধ দমনে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি ও নৌ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা হালদা নদী পরিদর্শন করে নৌ থানা স্থাপনের জন্য সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করেন। হাটহাজারীর মদুনাঘাট ও সত্তারঘাট এবং রাউজানের তেরপালই খাল এলাকায় প্রাথমিকভাবে স্থান নির্ধারণ করা হলেও এখন পর্যন্ত নৌ থানার অনুমোদন হয়নি। বর্তমানে অস্থায়ী ক্যাম্পের ও ফাঁড়ির মাধ্যমে নৌ পুলিশ টহল ও অভিযান পরিচালনা করছে, উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের সহায়তায়।
হালদা নদীর নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নদীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এসব সিসিটিভির মাধ্যমে নদীর গতিবিধি নজরদারি করা হয়। এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ নৌ থানার অনুপস্থিতিতে নজরদারি ও অভিযানের কার্যক্রম অনেক সময় ব্যাহত হচ্ছে। নদীর অভ্যন্তরে দ্রুত আইন প্রয়োগ, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি নৌ থানার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
[caption id="attachment_1635" align="alignnone" width="300"] ফাইল ছবি[/caption]
নৌ পুলিশ ও রিভার পুলিশ গত কয়েক বছর ধরে হালদায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত হালদা নদীতে ৪৬ হাজার মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল, ১ হাজার মিটার ঘেরা জাল ও অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু ভর্তি ড্রেজার নৌযান জব্দ করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মা মাছ ও পোনা নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযানে নদীর আশপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, দূষণকারী কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে। রিভার পুলিশের তথ্যমতে, ২০২২ সালের এক অভিযানে দেশের বিভিন্ন নৌপথে ১৪ দিনে ৬২১ জনকে গ্রেপ্তার এবং ১৪৮টি মামলা দায়ের করা হয়, যার বড় অংশ হালদা নদী ঘিরে পরিচালিত হয়েছিল।
[caption id="attachment_1636" align="alignnone" width="300"] ফাইল ছবি[/caption]
তবে নদী রক্ষার এই প্রচেষ্টা এখনও অস্থায়ী ও খণ্ডিত। হালদা নদীতে নৌ থানা স্থাপন হলে এখানে ২৪ ঘণ্টা টহল, আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে নজরদারি এবং দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা রক্ষা পাবে এবং মৎস্যজীবীরা প্রকৃতির দানে ভাগ বসাতে পারবে। নৌ থানার মাধ্যমে নদীর আশপাশের অবৈধ দখলদার ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
স্থানীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের লোকজনের মতে “প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে অবৈধ জেলেরা নদী ধ্বংস করে। আমরা নৌ থানার দাবি বহুবার জানিয়েছি। প্রশাসনের সাময়িক অভিযান নয়, স্থায়ী নিরাপত্তা দরকার।” পরিবেশকর্মী মোঃ আলী চৌধুরী বলেন, “হালদা শুধু নদী নয়, এটা আমাদের জীবনের অংশ। নৌ থানা ছাড়া নদীকে রক্ষা করা অসম্ভব।”
হালদা নদী এখন নদী রক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার নৌ থানার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও প্রশাসনিক জটিলতায় কাজটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্রকে বাঁচাতে হলে এখনই সময় নৌ থানার বাস্তবায়ন শুরু করার। নয়তো অমূল্য এই সম্পদ একদিন হারিয়ে যাবে, আর ফিরে পাওয়া যাবে না।